সংবাদ মূলত কাব‍্য: পর্ব ১১

ধ্বংসের মধ্যে যাত্রা

খুব খাতির করে শম্ভুদা আমাকে হাওড়ায় কুচিল ঘোষাল লেনে তার মাসির বাড়ির দাওয়ায় বসাল। কবিতার কথা হল খুব। শম্ভু রক্ষিতের প্রথম কবিতার বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন‍্য কান্না’ তখন সবে বের হয়েছে, আমাকে দিল শম্ভুদা। আর দিল তার সম্পাদিত ‘ব্লুজ’ পত্রিকা। এই ‘ব্লুজ’ পত্রিকা ভারি মনে ধরল আমার। ঘিয়ে রঙের আর্ট পেপারে ডবল ডিমাই সাইজের চার পাতার কাগজ। ‘ব্লুজ’-এ পড়লাম বিলেতে চলে যাওয়া উৎপলকুমার বসুর দু’টি লেখা, একটি গল্প ‘নরখাদক’। আর একটি খুচরো লেখায় উৎপলকুমার বিলেতের এক কবিসভার বিবরণ দিয়েছেন: সাহেব-কবি কবিতাপাঠে মঞ্চে উঠেছেন, তাঁর কোমরের বেল্টের দু’পাশের হোল্ডারে ঝুলছে দু’টি রিভলবার। দারুণ লাগল আমার।

আরও পড়ুন: একবার শাস্তি দিতে কয়েকজন মিলে যাওয়া হয়েছিল কবি শম্ভু রক্ষিতের বাড়ি, সেবার দরজা খুলেই যে-আশ্চর্য ঘটনাটি তিনি ঘটালেন! লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত…

তখন উত্তরপাড়া প‍্যারীমোহন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার ইচ্ছে হল ‘ব্লুজ’-এর ধাঁচে একটি কবিতাপত্র বের করার। শ্রীরামপুরের চাতরার সত‍্যনারায়ণ প্রেসে যোগাযোগ করে আকাশি রঙের আর্ট পেপার কিনলাম। তবে চার পাতা নয়, ডবল ডিমাই সাইজে এ পিঠ-ও পিঠ দু’পাতা হল সে-কাগজ। কলেজে প্রাণীবিদ‍্যা পড়তাম তো, পত্রিকার নাম দিয়েছিলাম ‘বাইসন’। পয়লা পিঠে আমার ছ-টি না আটটি কবিতা, অন‍্য পিঠে আমার বন্ধু দেব গঙ্গোপাধ‍্যায়ের (যে কিনা নিখোঁজ) কবিতা ছাপা হল। পত্রিকাটিতে আর কিছুই ছিল না, সম্পাদকীয়ও না। শ্রীরামপুর রেলস্টেশনে হকার এবং রিকশাচালকদের মধ‍্যে আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল, তারা তুমুল উৎসাহে হাওড়া থেকে ব‍্যান্ডেল-বর্ধমান, তারকেশ্বর লাইনে ১০ পয়সা দামের পত্রিকাটি নেচেকুদে বিক্রি করল। তাদের একজন, তারক, আমাকে বলল, বারাকপুর থেকে শিয়ালদা লাইনেও খান কুড়ি পত্রিকা সে পাঠিয়ে দিয়েছে। ১৫/২০ দিনের মাথায় রানাঘাট থেকে একটি পোস্টকার্ড পেলাম। সমবয়সি একজন ওই পোস্টকার্ডে ‘বাইসন’ পত্রিকাটি প্রাপ্তির কথা জানিয়ে লিখেছে, আমার কবিতাগুলি সে পড়েছে। আমার মন স্ফূর্ত হয়ে উঠল।

মাসখানেক পর বন্ধু ডালিমকে নিয়ে গেলাম রানাঘাট। রানাঘাটের সেই সমবয়সি পত্রলেখকটি আমাদের সেই শীতের দুপুরটিতে নিয়ে গেল কৃষ্ণনগরে দেবদাস আচার্যর কাছে। দেবদাসদার বাড়ি যাওয়ার পথে সুবোধ সরকারের বাড়িও নিয়ে গেল সে। সুবোধ সে-বছরেরই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার্থী, আলাপ-পরিচয়ের পর সুবোধ শিক্ষকের কাছে পড়তে গেল। দেবদাসদার রাধানগরের বাড়ি সে যেতে পারল না। দেবদাসদার তখন সবে ‘কালক্রম ও প্রতিধ্বনি’ নামে একটি কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেবদাসদার বাড়ির সামনে রাধানগরের মাঠে বসে আমি ও রানাঘাটের ওই তরুণটি নিজেদের কিছু কবিতা শোনালাম। দেবদাসদাও শোনালেন তাঁর নতুন কয়েকটি কবিতা। দেবদাসদাকে দিলাম ‘বাইসন’ পত্রিকাটি। এরপর সন্ধের ছায়া পড়া শীতকুয়াশা ভরা মাঠে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে দেবদাসদা বললেন, ‘আমরা আর প্রতিষ্ঠানকে লেখক সরবরাহ করব না।’ যেন হাওয়ায় পাক খেতে-খেতে ঊর্ধ্বাকাশে উঠে গেল ওই কথাটি।

কবি দেবদাস আচার্য
চিত্রগ্রাহক: সন্দীপ কুমার

পরে, ১৯৭৬ সালে দেবদাসদা কৃষ্ণনগর থেকে বের করেছিলেন কবিতাপত্র ‘ভাইরাস’। সস্তা নিউজপ্রিন্টে ডবল ডিমাই চার পাতার সেই কবিতা-পত্রিকাটি প্রতি মাসে দু’পয়সার ডাকটিকিটে, বুকপোস্টে তামাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ত, নবীন কবিদের মুখপত্র বা ইস্তাহার হিসেবে। মাত্র সাড়ে তিন/চার বছর বের হয়েছিল ‘ভাইরাস’। আমার সমবয়সি যে-কবিরা আজ পাঠক-পাঠিকার কাছে পরিচিতি পেয়েছেন, আমার মনে হয়, তাঁরা ওই ধূসর ফিনফিনে অথচ তেজস্ক্রিয় পত্রিকাজাত। কী তাই তো?

দেবদাস আচার্য সম্পাদিত ‘ভাইরাস’

ওই সব বয়সে, সেই ১৯৭৩/’৭৪ সাল থেকেই আমার পায়ের নীচে ছিল সর্ষে। যখন কলেজে পড়ি তখন তো বটেই, স্নাতক হবার পরেও খুব ঘুরে বেরিয়েছি। রানঘাট-কৃষ্ণনগর-বহরমপুর চলে গিয়েছি ইচ্ছে হলেই। চাঁপাডাঙা-আরামবাগ-বিষ্ণুপুর-সিউড়ি। বহরমপুর থেকে শুভ চট্টোপাধ্যায়, সমীরণ ঘোষ, ‘রৌরব’ পত্রিকা বের করত। তমলুক থেকে শ‍্যামলকান্তি দাশ চিঠি দিয়েছিল, সেখানে বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনের ফাঁকে জোরজবরদস্তি শ‍্যামলকান্তি সারা বাংলা কবিসম্মেলন ডেকে দিয়েছিল। আমি আর পল্লব গিয়েছিলাম তমলুক‌। পথে রেল অবরোধ ঘটায়, লরি থামিয়ে তমলুক গিয়েছিলাম। আমাদের আগেই তমলুকে পৌঁছেছিলেন গৌরাঙ্গ ভৌমিক, হ‍্যাজাকের আলোয় ঝলমল করছিল তাঁর মুখ।

কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিক

‘বাঁকানো চাঁদের ওই ফলাটি/তুমি বুঝি খুব ভালো বাসতে?/চাঁদের শতক এ নহে তো/এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে।’ কবি দিনেশ দাসের কবিতা। দিনেশ দাসকে আমি দেখিনি। তাঁর ছেলে শান্তনু দাসকে দেখেছি, আমাদের শ্রীরামপুরের কবিসম্মেলনে এসেছিলেন। ‘গঙ্গোত্রী’ নামে চকমকে একটি কবিতার কাগজ করতেন, তাতে আমার কবিতা ছেপেছেন। তমলুকে শান্তনু দাসের সঙ্গে দেখা হল। তিনি তাঁর বন্ধু রুদ্রেন্দু সরকারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। সে-সময়ে সবে বের হয়েছে রুদ্রেন্দু সরকারের কাব‍্যগ্রন্থ, সে-বইয়ের নাম, ‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে দাঁতের মাজন’। কাব‍্যগ্রন্থের এমন নামকরণে আমরা সেকালে খুবই আমোদিত হয়েছিলাম।

মফস্‌সল শহরগুলিতে সে-সময়ে মাঝেমধ‍্যেই ছোট পত্রিকাগুলিকে কেন্দ্র করে কবিসম্মেলন হত। তবে নির্বাচিত কবিদের কবিতাপাঠ। ৫০/১০০ কবির জমায়েত নয়। আবৃত্তিও হত না। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘ছেঁড়া তমসুক’ ছবিটিতে এমন একটি কবিসম্মেলনের দৃশ‍্য রয়েছে, কবি শক্তি চট্টোপাধ‍্যায়ের অসামান‍্য উপস্থিতি তাতে। তখন বাংলা আকাদেমি ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। তখন ঘোরাঘুরিতে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতেই ঘুরেছি, উত্তরবঙ্গে আমি বিশেষ ঘুরিনি।

শান্তনু দাস সম্পাদিত ‘গঙ্গোত্রী’

১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির বছরখানেক আগে থেকে গোটা দেশ যেন থমথম করছিল। ১৯৭৪ সালে  রাজস্থানের পোখরানে ইন্দিরা গান্ধী সরকার পারমাণবিক বোমা পরীক্ষায় সাফল‍্যলাভ করে। ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়। ওই সময়ে বের করেছিলাম ‘বাইসন’-এর দ্বিতীয় সংখ‍্যা। প্রচ্ছদে ছেপেছিলাম জীবনানন্দের সেই কবিতা: ‘অদ্ভুত আঁধার এক…’। আমাদের স্নাতক শ্রেণির ফাইনাল ওই ১৯৭৪ সালে বের হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষার পর মাঝে মাঝে কলেজে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম।  উত্তরপাড়া কলেজের সামনে জি টি রোডে অমরের মিষ্টির দোকানের বেঞ্চ ও তার লাগোয়া বালিখালের সড়কসেতুর পাঁচিলে বসতাম আমরা। ১৯৭৫-এর জানুয়ারির একদিন সকালে ওই আড্ডায় উদয়, শুভ্র, নরেন, আশিস, আমার বন্ধুরা জানাল, সেদিনই রাতে নর্থ বিহার এক্সপ্রেস ধরে তারা নেপাল যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে জয়বাহাদুর পড়ত, তাঁর বাড়ি কাঠমান্ডুর গ্রামে। শুনে আমি হইচই করলাম, আমাকে না জানানোর জন‍্য। শুনে উদয় আমাকে বলল, ‘এক্ষুনি ১২৫ টাকা দে।’ উদয়ের বাবা রেলের অফিসার, তিনি ব‍্যবস্থা করে দেবেন। ১২৫ টাকা তখন অনেক টাকা। শেওড়াফুলির বিপিন আমাদের সহপাঠী, সে তখনই হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করে। সে শেওড়াফুলির ব‍্যাঙ্কে দৌড়ল, ঘণ্টা দুই পর উদয়কে টাকা দিয়ে দিল।

হাওড়া থেকে রাতের নর্থ বিহার এক্সপ্রেসে সমস্তিপুর রওনা হলাম আমরা। এর দিন সাতেক আগে ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে ওই স্টেশনেই গিয়ে সমস্তিপুর-মুজফফরপুর ব্রডগেজ লাইন উদ্বোধন করতে গিয়ে রেলমন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্র বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন, সে-খবর আমরা জানতাম। পরদিন দুপুরের পর যখন আমাদের ট্রেন একের পর এক উত্তর বিহারের স্টেশনগুলি পার হয়ে যাচ্ছে, তখন জামুই… কিউল… বারাউনি জংশন স্টেশনে ট্রেন থেকে শুনলাম শহরগুলি ও শিল্পাঞ্চল থেকে জনগর্জন: তানাশাহি নহি চলে গা… ইন্দিরা হঠাও… বিহার তখন কাঁপছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের ইন্দিরাবিরোধী আন্দোলনে। অর্থাৎ আমি ইতিহাসের ভিতরে ছিলাম। আমি ইতিহাসের ভিতরে আছি।

সন্ধ‍্যায় পৌঁছলাম সমস্তিপুর স্টেশনে। পরদিন ভোরে এখান থেকেই সীমান্ত স্টেশন রক্সৌলের ন‍্যারোগেজের ট্রেনে উঠব। সমস্তিপুর স্টেশনটি দুধের মতো ধবধব করছিল। এক সপ্তাহ আগে রেলমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে রং করা হয়েছিল, পরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল। ধু-ধু করছিল প্ল‍্যাটফর্মগুলি। একটি জায়গায় রেলপুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী পাহারা দিচ্ছিল দড়ি দিয়ে কিয়দংশ ঘিরে। সেখানে দেখলাম সাদা দেওয়ালে বিস্ফোরণের দগদগে পোড়া দাগ…